Wellcome to National Portal
মেনু নির্বাচন করুন
Main Comtent Skiped

প্রখ্যাত ব্যক্তিত্ব

শেখ লুৎফর রহমান

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এঁর পিতা শেখ লুৎফর রহমান ১৮৮১ সালে তৎকালীন ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জ মহকুমার টুঙ্গিপাড়ার এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। শেখ লুৎফর রহমান পেশাগত জীবনে ছিলেন দেওয়ানি আদালতের সেরেস্তাদার। দুই ভাইয়ের পড়াশোনা ও বোনদের বিবাহের দায়িত্ব সামলাতে গিয়ে তিনি এন্ট্রেন্স (বর্তমানে এসএসসি) পাশ করেই চাকরিতে যোগ দেন। তাঁর বাবার নাম শেখ আবদুল হামিদ।

গোপালগঞ্জ মহকুমার টুঙ্গিপাড়া গ্রামে স্ত্রী সায়েরা খাতুনের সাথে সংসার শুরু করেন শেখ লুৎফর রহমান। সায়েরা খাতুন ছিলেন তাঁর চাচাতো বোন। লুৎফর-সায়েরা দম্পতির ছয় সন্তান যথাক্রমে ফাতেমা বেগম, আছিয়া বেগম, শেখ মুজিবুর রহমান, আমেনা বেগম, শেখ আবু নাসের ও খোদেজা বেগম। ১৯৩৬ সালে তিনি বদলি হয়ে মাদারীপুর মহকুমায় যান। সে-সময় শেখ মুজিবুর রহমান গ্লুকোমা রোগে আক্রান্ত হন। তিনি শেখ মুজিবকে তখন তাঁর সঙ্গেই রাখতেন। ১৯৩৪ ও ১৯৩৬ সালে চিকিৎসার জন্য তিনি শেখ মুজিবকে কলকাতা নিয়ে যান। ১৯৩৭ সালে শেখ মুজিব সুস্থ হয়ে পড়াশোনা শুরু করলে ছেলের পড়াশোনার উন্নতির জন্য তিনি গৃহশিক্ষক রাখেন। শিক্ষকদের একজন কাজী আবদুল হামিদের 'মুসলিম সেবা সমিতি'র সঙ্গে যুক্ত ছিলেন শেখ মুজিব। ছেলে মুসলিম সেবা সমিতির কাজ করতে গিয়ে নানা ঝামেলায় পড়লেও তিনি কখনো তাঁকে এসব কাজে বাধা দিতেন না।

শেখ লুৎফর রহমান ছিলেন খুবই রাজনীতি সচেতন। খবরের কাগজ পড়তেন এবং বেশ কয়েকটি খবরের কাগজ রাখতেন বাসায়। শেখ মুজিবও বাবার দেখাদেখি নিয়মিত পত্রিকা পড়তেন। ছোটবেলার এই পাঠাভ্যাস শেখ মুজিবের রাজনৈতিক চিন্তার বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। বাবা হিসেবে তিনি ছেলে শেখ মুজিবের রাজনীতিতে কখনো বাধা দিতেন না। তিনি রাজনীতির পাশাপাশি লেখাপড়ায় নজর রাখতে বলতেন। রাজনীতি নিয়েও তিনি ছেলের সঙ্গে আলোচনা করতেন। তিনি ছিলেন শেরে বাংলা একে ফজলুল হকের ভক্ত।

ছেলে শেখ মুজিবকে ঘিরে শেখ লুৎফর রহমানের আকাঙ্ক্ষা ছিলো বড়। তিনি চাইতেন ছেলে বড় হয়ে আইনজীবী হয়ে দেশ ও দশের সেবা করবেন। চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের আন্দোলনে অংশ নেয়ার অভিযোগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শেখ মুজিবকে বহিষ্কার করার পর তিনি বাড়ি ফিরলে বাবা শেখ লুৎফর রহমান তাঁকে লন্ডনে পাঠাতে চেয়েছিলেন ব্যারিস্টারি পড়াতে। বাবা চাইলেও শেখ মুজিব তাতে রাজি ছিলেন না। তিনি ছিলেন স্নেহপ্রবণ পিতা। শেখ মুজিবকে কখনো তাঁর কাজে বাধা দিতেন না। তিনি তাঁকে 'খোকা' বলে ডাকতেন।

মুক্তিযুদ্ধের সময় শেখ লুৎফর রহমান ও সায়েরা খাতুন তাঁদের ছোট ছেলে শেখ নাসেরের পরিবারসহ টুঙ্গিপাড়াতেই ছিলেন। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী শেখ লুৎফর রহমানের বাড়িটি আগুনে পুড়িয়ে দেয়। পাকিস্তানি বাহিনী ও রাজাকারদের বারবার আক্রমণে বাধ্য হয়ে বাড়ি ছেড়ে তাঁরা ঢাকায় চলে আসেন এবং ফকিরাপুলে বড় মেয়ে ফাতেমা বেগমের জামাতা মীর আশরাফ উদ্দীনের বাসায় আশ্রয় নেন। পরে ঢাকার সোবহানবাগে ছোট মেয়ের বাড়িতে চলে আসেন শেখ লুৎফর রহমান ও সায়েরা খাতুন। বিজয় লাভের পূর্ব পর্যন্ত তাঁরা সেখানেই ছিলেন।

১৯৭৫ সালের ৩০ মার্চ শেখ লুৎফর রহমান ঢাকায় ধানমন্ডি ৩২ নম্বর রোডের বাড়িতে অসুস্থ অবস্থায় মারা যান। মৃত্যুর পর তাঁকে টুঙ্গিপাড়ায় স্ত্রীর কবরের পাশে সমাহিত করা হয়। টুঙ্গিপাড়ায় মধুমতি নদীর ওপর নির্মিত সেতুর নামকরণ করা হয়েছে ‘শেখ লুৎফর রহমান সেতু’। এছাড়া, গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায় তাঁর নামে ‘কোটালীপাড়া শেখ লুৎফর রহমান আদর্শ সরকারি কলেজ’ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

   তথ্যসূত্র :    মুজিবপিডিয়া

সায়েরা খাতুন

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মা সায়েরা খাতুনের জন্ম ১৮৮৬ সালে, সে-সময়ের ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জ মহকুমার টুঙ্গিপাড়া গ্রামে। সায়েরা খাতুনের বাবার নাম শেখ আবদুল মজিদ। তিনি ছিলেন শেখ মুজিবের দাদা শেখ আবদুল হামিদের বড় ভাই। সায়েরা খাতুন ছিলেন বাবার চার কন্যার মধ্যে সবচেয়ে ছোট ও আদরের। সায়েরা খাতুন ব্যক্তিগত জীবনে ছিলেন ধার্মিক ও দয়ালু। প্রায়ই শেখ মুজিব তাঁর গরিব সহপাঠীদের খাওয়ানোর জন্য বাড়িতে নিয়ে আসতেন। মা সায়েরা খাতুন কখনো আপত্তি করেননি, বরং ছেলের উদারতায় খুশি হতেন। সে-সময় তাঁদের ঘরে আশ্রিত ছেলেমেয়েও থাকতো বেশ কয়েকজন।

১৯২০ সালের ১৭ মার্চ সায়েরা খাতুনের কোল আলো করে জন্ম হয় শেখ মুজিবুর রহমানের। বঙ্গবন্ধুর শৈশব সম্পর্কে এক ভিডিও সাক্ষাৎকারে সায়েরা খাতুন বলেন, ‘এমন কিছু সে করেনি যা ভালো নয়’। মা-বাবার মতে, তাঁদের বংশে তিনপুরুষেও শেখ মুজিবের মতো এমন নির্ভীক, সৎ ও সাহসী ছেলে জন্ম নেয়নি। শেখ মুজিবকে আদর করে ‘খোকা’ নামেই ডাকতেন তাঁরা। পিতা শেখ লুৎফর রহমান চাকুরিসূত্রে দূরে থাকায়, শেখ মুজিবের পুরো শৈশব কেটেছে মায়ের সাথেই।

মুক্তিযুদ্ধের সময় সায়েরা খাতুন ও শেখ লুৎফর রহমান তাঁদের ছোট ছেলে শেখ নাসেরের পরিবারসহ টুঙ্গিপাড়াতেই ছিলেন। পাকিস্তানি সৈন্যরা শেখ লুৎফর রহমানের বাড়িটি আগুনে পুড়িয়ে দেয়। এছাড়াও সায়েরা খাতুনের পৈত্রিক বাড়ি এবং শেখ লুৎফর রহমানের চাচাতো ভাই খান সাহেব শেখ মোশারফ হোসেনের বাড়িসহ বেশ কিছু বাড়িতে লুট-পাট করে আগুন লাগিয়ে দেয় পাকিস্তানি সেনারা। এক পর্যায়ে বাধ্য হয়ে বাড়ি ছেড়ে তাঁরা ঢাকায় চলে আসেন। পরে ঢাকার সোবহানবাগে ছোট মেয়ে খোদেজা বেগমের বাড়িতে চলে আসেন শেখ লুৎফর রহমান ও সায়েরা খাতুন। বিজয় লাভের পূর্ব পর্যন্ত তাঁরা সেখানেই ছিলেন।

১৯৭৪ সালের ৩১ মে সায়েরা খাতুন মারা যান। টুঙ্গিপাড়াতে সায়েরা খাতুনকে সমাহিত করা হয়। পরবর্তীকালে সেখানে গড়ে তোলা হয় ‘বঙ্গবন্ধু সমাধিসৌধ কমপ্লেক্স’। সায়েরা খাতুন স্মরণে ২০১১ সালে গোপালগঞ্জে তৈরি করা হয়েছে ‘শেখ সায়েরা খাতুন মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল’।

                                                                                                                                                                                                                                                                                                         তথ্যসূত্র :    মুজিবপিডিয়া


বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান

সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙ্গালী স্বাধীনতার মহান স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়া গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম শেখ লুৎফর রহমান ও মাতার নাম সায়েরা খাতুন। বাবা-মা তাঁকে খোকা বলে ডাকতেন । তাঁর শৈশবকাল কাটে টুঙ্গিপাড়ায়।

১৯২৭
টুঙ্গিপাড়া এম ই স্কুলে শেখ মুজিবের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা শুরু হয়। পরে স্কুলটির নাম হয় গিমাডাঙা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। তিনি এই স্কুলে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়েন।

১৯৩৪
সপ্তম শ্রেণিতে পড়ার সময় বেরিবেরি রোগে আক্রান্ত হন। দুই বছর তাঁর পড়াশোনা বন্ধ ছিল।

১৯৩৬
মাদারীপুর হাইস্কুলে সপ্তম শ্রেণিতে পড়ার সময় তিনি গ্লুকোমা রোগে আক্রান্ত হন। এসময় তাঁর দুই চোখেই অপারেশন করা হয়।

১৯৩৭
গোপালগঞ্জ মিশন স্কুলে ভর্তি হয়ে পুনরায় পড়াশোনা শুরু করেন।

১৯৩৮
বাংলার প্রধানমন্ত্রী শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক এবং শ্রমমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী গোপালগঞ্জ সফরে আসেন। তাদের অভ্যর্থনা জানানোর জন্য স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী করার দায়িত্ব পালন করেন শেখ মুজিব। সেসময় তিনি শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নজরে আসেন। পরবর্তীতে তাঁর হাত ধরেই শেখ মুজিব রাজনীতিতে যুক্ত হন।

১৯৩৯
শেখ মুজিব কলকাতা গিয়ে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে দেখা করেন। তাঁকে গোপালগঞ্জে আসতে অনুরোধ করেন এবং গোপালগঞ্জে মুসলিম ছাত্রলীগ ও মুসলিম লীগ গঠন করতে নিজের আগ্রহের কথা জানান। এর ধারাবাহিকতায় গোপালগঞ্জ মুসলিম ছাত্রলীগ ও মুসলিম লীগ গঠিত হয়। শেখ মুজিব মুসলিম ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাতাকালীন সম্পাদক হন।

১৯৪১
ম্যট্রিক পরীক্ষা দিয়ে মাদারীপুরে যেয়ে মুসলিম ছাত্রলীগ গঠন করেন।

১৯৪২
কলকাতা ইসলামিয়া কলেজে ভর্তি হন এবং বেকার হোস্টেলে তাঁর থাকার ব্যবস্থা হয়। শেখ মুজিব এই বছরেই পাকিস্তান আন্দোলনের সাথে সক্রিয়ভাবে যুক্ত হয়ে পড়েন।

১৯৪৩
প্রাদেশিক মুসলিম লীগ কাউন্সিলের সদস্য হন। এই সময়ের ভয়াবহ দুর্ভিক্ষে দুর্ভিক্ষপীড়িতদের সেবায় তিনি অনেকগুলি লঙ্গরখানা খুলেন।

১৯৪৪
কলকাতায় অবস্থিত ফরিদপুরবাসীর উদ্যোগে গঠিত “ফরিদপুর ডিসট্রিক্ট এসোসিয়েশন”- এর সম্পাদক নির্বাচিত হন।

১৯৪৬
ইসলামিয়া কলেজের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে শেখ মুজিব ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। একই বছরে দিল্লীতে অনুষ্ঠিত মুসলিম লীগ কনভেনশনে যোগদান করেন।

১৯৪৭
ইসলামিয়া কলেজ থেকে বি.এ পাশ করেন। এই বছরের শেষ দিকে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে ভর্তি হন।

১৯৪৮
শেখ মুজিবের উদ্যোগে ৪ জানুয়ারি পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ গঠন করা হয়। ১১ই মার্চ বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ডাকা ধর্মঘট থেকে তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। ১৫ মার্চ তিনি মুক্তি লাভ করেন। মুক্তি লাভের পর ১৬ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত ছাত্র-জনতার সভায় তিনি সভাপতিত্ব করেন।

১৯৪৯
২৩ জুন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠিত হয়। সেসময় জেলে থাকা অবস্থায় শেখ মুজিব এ দলের যুগ্ম সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৪৯ সালের ডিসেম্বর মাস থেকে ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত দীর্ঘ সময় শেখ মুজিব কারাবন্দি ছিলেন।

১৯৫২
জানুয়ারি মাসে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন ঘোষণা করেন ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু’। তখন একমাত্র রাজনৈতিক দল পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ, ছাত্র প্রতিষ্ঠান ছাত্রলীগ এবং যুবাদের প্রতিষ্ঠান যুবলীগ সকলেই এর তীব্র প্রতিবাদ করে। সে সময় জেলে থাকা অবস্থায় শেখ মুজিব ২১শে ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা দিবস পালন এবং সভা করে সংগ্রাম পরিষদ গঠন করতে বলেন। ২১ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ছাত্র সমাজ ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে মিছিল বের করে। মিছিলে পুলিশ গুলি চালালে সালাম, বরকত, রফিক, শফিউর শহীদ হন। শেখ মুজিব জেলখানা থেকে এক বিবৃতিতে ছাত্র মিছিলে পুলিশের গুলিবর্ষণের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানান। জেল থেকে মুক্তির পর ডিসেম্বর মাসে তিনি “পিকিং”-এ শান্তি সম্মেলনে যোগদান করেন।

১৯৫৩
আওয়ামী লীগের কাউন্সিলে তিনি দলের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। কাউন্সিল সভায় আওয়ামী লীগের ম্যানিফেস্টো ও গঠনতন্ত্র গ্রহন করা হয়।

১৯৫৪
প্রথম সাধারণ নির্বাচনে ২৩৭টি আসনের মধ্যে যুক্তফ্রন্ট লাভ করে ২২৩ আসন। এর মধ্যে আওয়ামী লীগ পায় ১৪৩টি আসন। শেখ মুজিব গোপালগঞ্জের আসনে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীকে প্রায় দশ হাজার ভোটে পরাজিত করে নির্বাচিত হন। ১৫ মে তিনি প্রাদেশিক সরকারের কৃষি ও বন মন্ত্রীর দায়িত্ব লাভ করেন। ৩০ মে কেন্দ্রীয় সরকার যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রীসভা বাতিল করে দেয়। ৩০ মে শেখ মুজিব করাচী থেকে ঢাকায় প্রত্যাবর্তন করেন এবং গ্রেফতার হন। ডিসেম্বর তিনি মুক্তি লাভ করেন।

১৯৫৫
৫ জুন শেখ মুজিব গণপরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। আওয়ামী লীগের উদ্যোগে ১৭ জুন ঢাকার পল্টন ময়দানের জনসভা থেকে পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন দাবি করে ২১ দফা ঘোষণা করা হয়। ২৩ জুন আওয়ামী লীগের কার্যকরী পরিষদে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যে, পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন প্রদান করা না হলে দলীয় সদস্যরা আইনসভা থেকে পদত্যাগ করবেন। ২১ অক্টোবর আওয়ামী মুসলিম লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে দলের নাম থেকে ‘মুসলিম’ শব্দ প্রত্যাহার করা হয় এবং শেখ মুজিব পুনরায় দলের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।

১৯৫৬
৩ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ মুখ্যমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাৎ করে খসড়া শাসনতন্ত্রে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনে বিষয়টি অন্তর্ভুক্তির দাবি জানান। ১৪ জুলাই আওয়ামী লীগের সভায় প্রশাসনে সামরিক বাহিনীর প্রতিনিধিত্বের বিরোধিতা করে একটি সিদ্ধান্ত প্রস্তাব গৃহীত হয়। এই সিদ্ধান্ত প্রস্তাব আনেন বঙ্গবন্ধু। ৪ সেপ্টেম্বর বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে খাদ্যের দাবিতে ভুখা মিছিল বের করা হয়। চকবাজার এলাকায় পুলিশ মিছিলে গুলি চালালে ৩ জন নিহত হয়। ১৬ সেপ্টেম্বর বঙ্গবন্ধু কোয়ালিশন সরকারের শিল্প, বাণিজ্য, শ্রম, দুর্নীতি দমন ও ভিলেজ এইড দপ্তরের মন্ত্রীর দায়িত্ব লাভ করেন।

১৯৫৭
সংগঠনকে সুসংগঠিত করার উদ্দেশ্যে ৩০ মে দলীয় সিদ্ধান্ত অনুযায়ী শেখ মুজিব মন্ত্রীসভা থেকে পদত্যাগ করেন।

১৯৫৮
৭ অক্টোবর পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট মেজর জেনারেল ইস্কান্দার মির্জা ও সামরিক বাহিনী প্রধান জেনারেল আইয়ুব খান সামরিক শাসন জারি করে রাজনীতি নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। ১১ অক্টোবর বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করা হয় এবং একের পর এক মিথ্যা মামলা দায়ের করে হয়রানি করা হয়। প্রায় চৌদ্দ মাস জেলখানায় থাকার পর তাকে মুক্তি দিয়ে পুনরায় জেলগেটেই গ্রেফতার করা হয়।

১৯৬০
৭ ডিসেম্বর হাইকোর্টে রিট আবেদন করে তিনি মুক্তি লাভ করেন। সামরিক শাসন ও আইয়ুব বিরোধী আন্দোলন গড়ে তোলার লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু গোপন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেন। এ সময়ই বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের লক্ষ্যে কাজ করার জন্য বিশিষ্ট ছাত্র নেতৃবৃন্দ দ্বারা ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ’ নামে একটি গোপন সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। প্রতি মহকুমা এবং থানায় নিউক্লিয়াস গঠন করেন।

১৯৬২
৬ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধুকে জননিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার করা হয়। ২ জুন চার বছরের সামরিক শাসনের অবসান ঘটলে ১৮ জুন বঙ্গবন্ধু মুক্তি লাভ করেন। ২৫ জুন বঙ্গবন্ধুসহ জাতীয় নেতৃবৃন্দ আইয়ুব খানের মৌলিক গণতন্ত্র ব্যবস্থার বিরুদ্ধে যৌথ বিবৃতি দেন। ৫ জুলাই পল্টনের জনসভায় বঙ্গবন্ধু আইয়ুব সরকারের কঠোর সমালোচনা করেন। ২৪ সেপ্টেম্বর বঙ্গবন্ধু লাহোর যান, এখানে শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে বিরোধী দলীয় মোর্চ জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট গঠিত হয়। অক্টোবর মাসে গণতান্ত্রিক ফ্রন্টের পক্ষে জনমত সৃষ্টির জন্য তিনি শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সাথে সারা বাংলা সফর করেন।

১৯৬৩
সোহরাওয়ার্দী অসুস্থ হয়ে চিকিৎসার জন্য লন্ডনে অবস্থানকালে বঙ্গবন্ধু তার সঙ্গে পরামর্শের জন্য লন্ডন যান। ৫ ডিসেম্বর সোহরাওয়ার্দী বৈরুতে ইন্তেকাল করেন।

১৯৬৪
২৫ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে অনুষ্ঠিত এক সভায় আওয়ামী লীগকে পুনরুজ্জীবিত করা হয়। এই সভায় দেশের প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকদের ভোটের মাধ্যমে সংসদীয় সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তনের দাবি সাধারণ মানুষের ন্যায্য অধিকার আদায় সম্বলিত প্রস্তাব গৃহীত হয়। সভায় মওলানা আবদুর রশিদ তর্কবাগীশ ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব যথাক্রমে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১১ মার্চ বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠন হয়। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে দাঙ্গা প্রতিরোধ কমিটি গঠিত হয়। দাঙ্গার পর আইয়ুব বিরোধী ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের প্রস্তুতি গ্রহণের জন্য বঙ্গবন্ধু উদ্যোগ গ্রহণ করেন। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের ১৪ দিন পূর্বে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করা হয়।

১৯৬৫
শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতা ও আপত্তিকর বক্তব্য প্রদানের অভিযোগে মামলা দায়ের করা হয়। এক বছরের কারাদণ্ড প্রদান করা হয়। পরবর্তীতে হাইকোর্টের নির্দেশে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে তিনি মুক্তিলাভ করেন।

১৯৬৬
৫ ফেব্রুয়ারি লাহোরে বিরোধী দলসমূহের জাতীয় সম্মেলনের বিষয় নির্বাচনী কমিটিতে বঙ্গবন্ধু ঐতিহাসিক ৬ দফা দাবি পেশ করেন। প্রস্তাবিত ৬ দফা ছিল বাঙালি জাতির মুক্তি সনদ। ১ মার্চ বঙ্গবন্ধু আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। বঙ্গবন্ধু ৬ দফার পক্ষে জনমত সৃষ্টির উদ্দেশ্যে সারা বাংলায় গণসংযোগ সফর শুরু করেন। এ সময় তাকে সিলেটে, ময়মনসিংহ ও ঢাকায় বার বার গ্রেফতার করা হয়। বঙ্গবন্ধু এ বছরের প্রথম তিন মাসে আট বার গ্রেফতার হন। ৮ মে নারায়ণগঞ্জ পাটকল শ্রমিকদের জনসভায় বক্তৃতা শেষে তাকে পুনরায় গ্রেফতার করা হয়। ৭ জুন বঙ্গবন্ধু ও আটক নেতৃবৃন্দের মুক্তির দাবিতে সারাদেশে ধর্মঘট পালিত হয়। ধর্মঘটের সময় ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও টঙ্গীতে পুলিশের গুলিতে তেজগাঁও শিল্প এলাকায় মনু মিয়াসহ ১১ জন শ্রমিক নিহত হয়।

১৯৬৮
৩ জানুয়ারি পাকিস্তান সরকার বঙ্গবন্ধুকে এক নম্বর আসামি করে মোট ৩৫ জন বাঙালি সেনা ও সি এস পি অফিসারের বিরুদ্ধে পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করার অভিযোগ এনে রাষ্ট্রদ্রোহী হিসাবে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করে। ১৭ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুকে জেল থেকে মুক্তি দিয়ে পুনরায় জেল গেট থেকে গ্রেফতার করে ঢাকা সেনানিবাসে আটক রাখা হয়। বঙ্গবন্ধুসহ আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার অভিযুক্ত আসামিদের মুক্তির দাবিতে সারাদেশে বিক্ষোভ শুরু হয়। ১৯ জুন ঢাকা সেনানিবাসে কঠোর নিরাপত্তার মধ্যে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামিদের বিচার কার্য শুরু হয়।

১৯৬৯
৫ জানুয়ারি ৬ দফাসহ ১১ দফা দাবি আদায়ের লক্ষ্যে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার ও বঙ্গবন্ধুর মুক্তির দাবিতে দেশব্যাপী ছাত্র আন্দোলন শুরু করে। এই আন্দোলন গণআন্দোলনে পরিণত হয়। পরে ১৪৪ ধারা ও কারফিউ ভঙ্গ, পুলিশ-ইপিআর-এর গুলিবর্ষণ, বহু হতাহতের মধ্য দিয়ে গণঅভ্যুত্থানে রূপ নিলে আইয়ুব সরকার ০১ ফেব্রুয়ারি গোলটেবিল বৈঠকের আহ্বান জানায় এবং বঙ্গবন্ধুকে প্যারোলে মুক্তিদান করা হবে বলে ঘোষণা দেওয়া হয়। বঙ্গবন্ধু প্যারোলে মুক্তিদান প্রত্যাখ্যান করেন। ২২ ফেব্রুয়ারি জনগণের অব্যাহত চাপের মুখে কেন্দ্রীয় সরকার আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করে বঙ্গবন্ধুসহ অন্যান্য আসামিকে মুক্তি দানে বাধ্য হয়। ২৩ ফেব্রুয়ারি রেসকোর্স (সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) ময়দানে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে বঙ্গবন্ধুকে সংবর্ধনার আয়োজন করা হয়। প্রায় ১০ লাখ ছাত্র জনতার এই সংবর্ধনা সমাবেশে শেখ মুজিবুর রহমানকে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়। বঙ্গবন্ধু রেসকোর্স ময়দানের ভাষণে ছাত্র সমাজের ১১ দফা দাবির প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানান। ১০ মার্চ বঙ্গবন্ধু রাওয়ালপিন্ডিতে আইয়ুব খানের গোলটেবিল বৈঠকে যোগদান করেন। বঙ্গবন্ধু গোলটেবিল বৈঠকে আওয়ামী লীগের ৬ দফা ও ছাত্র সমাজের ১১ দফা দাবি উপস্থাপন করে বলেন, ‘গণ-অসন্তোষ নিরসনে ৬ দফা ও ১১ দফার ভিত্তিতে আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন প্রদান ছাড়া আর কোন বিকল্প নেই।” পাকিস্তানে শাসকগোষ্ঠী ও রাজনীতিবিদরা বঙ্গবন্ধুর দাবি অগ্রাহ্য করলে ১৩ মার্চ তিনি গোলটেবিল বৈঠক ত্যাগ করেন এবং ১৪ মার্চ ঢাকায় ফিরে আসেন। ২৫ মার্চ জেনারেল ইয়াহিয়া খান সামরিক শাসন জারির মাধ্যমে ক্ষমতাসীন হন। ২৫ অক্টোবর বঙ্গবন্ধু তিন সপ্তাহের সাংগঠনিক সফরে লন্ডন গমন করেন। ৫ ডিসেম্বর শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে আওয়ামী লীগের আলোচনা সভায় বঙ্গবন্ধু পূর্ব বাংলার নামকরণ করেন ’বাংলাদেশ’। তিনি বলেন, “একসময় এদেশের বুক হইতে, মানচিত্রের পৃষ্ঠা হইতে ‘বাংলা’ কথাটির সর্বশেষ চিহ্নটুকুও চিরতরে মুছিয়া ফেলার চেষ্টা করা হইয়াছে। … একমাত্র ‘বঙ্গোপসাগর’ ছাড়া আর কোন কিছুর নামের সঙ্গে ‘বাংলা’ কথাটির অস্তিত্ব খুঁজিয়া পাওয়া যায় নাই। … জনগণের পক্ষ হইতে আমি ঘোষণা করিতেছি- আজ হইতে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশটির নাম ‘পূর্ব পাকিস্তানে’র পরিবর্তে শুধুমাত্র ‘বাংলাদেশ’।

১৯৭০
৬ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু পুনরায় আওয়ামী লীগ সভাপতি নির্বাচিত হন। ১ এপ্রিল আওয়ামী লীগ কার্যকরী পরিষদের সভায় নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ৭ জুন রেসকোর্স ময়দানের জনসভায় বঙ্গবন্ধু ৬ দফার প্রশ্নে আওয়ামী লীগকে নির্বাচিত করার জন্য দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানান। ১৭ অক্টোবর বঙ্গবন্ধু তার দলের নির্বাচনী প্রতীক হিসাবে ‘নৌকা’ প্রতীক পছন্দ করেন এবং ঢাকার ধোলাইখালে প্রথম নির্বাচনী জনসভার মধ্য দিয়ে নির্বাচনী প্রচারণা শুরু করেন। ২৮ অক্টোবর তিনি জাতির উদ্দেশ্যে বেতার-টিভি ভাষণে ৬ দফা বাস্তবায়নে আওয়ামী লীগ প্রার্থীদের জয়যুক্ত করার জন্য দেশবাসীর প্রতি আহবান জানান। ১২ নভেম্বরের গোর্কিতে উপকূলীয় এলাকার ১০ লক্ষ মানুষের প্রাণহানি ঘটলে বঙ্গবন্ধু নির্বাচনী প্রচারণা বাতিল করে দুর্গত এলাকায় চলে যান এবং আর্ত-মানবতার প্রতি পাকিস্তানি শাসকদের ঔদাসীন্যের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানান। তিনি গোর্কি উপদ্রুত মানুষের ত্রাণের জন্য বিশ্ববাসীর প্রতি আহ্বান জানান। ৭ ডিসেম্বরে সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। আওয়ামী লীগ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে জাতীয় পরিষদের ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি আসন এবং প্রাদেশিক পরিষদের ৩০০টি আসনের মধ্যে ২৮৮টি আসন লাভ করে।

১৯৭১
৩ জানুয়ারি রেসকোর্সের জনসভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব জনপ্রতিনিধিদের শপথ গ্রহণ পরিচালনা করেন। আওয়ামী লীগ দলীয় সদস্যরা ৬ দফার ভিত্তিতে শাসনতন্ত্র রচনা এবং জনগণের প্রতি আনুগত্য থাকার শপথ গ্রহণ করেন। ৫ জানুয়ারি তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানে সর্বাধিক আসন লাভকারী পাকিস্তান পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো কেন্দ্রে আওয়ামী লীগের সাথে কোয়ালিশন সরকার গঠনে তার সম্মতির কথা ঘোষণা করেন। জাতীয় পরিষদ সদস্যদের এক বৈঠকে বঙ্গবন্ধু পার্লামেন্টারি দলের নেতা নির্বাচিত হন। ২৮ জানুয়ারি জুলফিকার আলী ভুট্টো বঙ্গবন্ধুর সাথে আলোচনার জন্য ঢাকায় আসেন। তিন দিন বৈঠকের পর আলোচনা ব্যর্থ হয়ে যায়। ১৩ ফেব্রুয়ারি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ৩ মার্চ ঢাকায় জাতীয় পরিষদের বৈঠক আহ্বান করেন। ১৫ ফেব্রুয়ারি ভুট্টো ঢাকায় জাতীয় পরিষদের বৈঠক বয়কটের ঘোষণা দিয়ে দুই প্রদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ দুই দলের প্রতি ক্ষমতা হস্তান্তর করার দাবি জানান। ১৬ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু এক বিবৃতিতে জনাব ভুট্টোর দাবির তীব্র সমালোচনা করে বলেন, ‘ভুট্টো সাহেবের দাবি সম্পূর্ণ অযৌক্তিক। ক্ষমতা একমাত্র সংখ্যাগরিষ্ঠ দল আওয়ামী লীগের কাছে হস্তান্তর করতে হবে। ক্ষমতার মালিক এখন পূর্ব বাংলার জনগণ।’

১ মার্চ ইয়াহিয়া খান অনির্দিষ্টকালের জন্য জাতীয় পরিষদের বৈঠক স্থগিতের ঘোষণা দিলে সারা বাংলায় প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। বঙ্গবন্ধুর সভাপতিত্বে আওয়ামী লীগ কার্যকরী পরিষদের জরুরি বৈঠকে ৩ মার্চ দেশব্যাপী হরতাল আহ্বান করা হয়। ৩ মার্চ সারা বাংলায় হরতাল পালিত হবার পর বঙ্গবন্ধু অবিলম্বে ক্ষমতা হস্তান্তর করার জন্য প্রেসিডেন্টের প্রতি দাবি জানান।

৭ মার্চ রেসকোর্সের জনসমুদ্র থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষণা করেন ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, জয় বাংলা’। ঐতিহাসিক ভাষণে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতিকে শৃঙ্খল মুক্তির আহ্বান জানিয়ে ঘোষণা করেন, “প্রত্যেকে ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে।… রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরও দেবো। এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাআল্লাহ্।’ তিনি শত্রুর বিরুদ্ধে সর্বাত্মক প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য সবাইকে প্রস্তুত থাকার আহবান জানান এবং ইয়াহিয়া খানের সরকারের বিরুদ্ধে অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন। একদিকে রাষ্ট্রপতি জেনারেল ইয়াহিয়ার নির্দেশ যেত, অপরদিকে ধানমন্ডি ৩২ নং সড়ক থেকে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ যেত, বাংলার মানুষ বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ মেনে চলতেন। অফিস, আদালত, ব্যাংক, বীমা, স্কুল-কলেজ, গাড়ি, শিল্প-কারখানা সবই বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ মেনেছে। ইয়াহিয়ার সব নির্দেশ অমান্য করে অসহযোগ আন্দোলনে বাংলার মানুষের সেই অভূতপূর্ব সাড়া ইতিহাসে বিরল ঘটনা। মূলত ৭ মার্চ থেকে ২৫ মার্চ বাংলাদেশ স্বাধীন দেশ হিসেবে বঙ্গবন্ধুই রাষ্ট্রপরিচালনা করেছেন। ১৬ মার্চ ঢাকায় ক্ষমতা হস্তান্তর প্রসঙ্গ মুজিব-ইয়াহিয়া বৈঠক শুরু হয়। আলোচনার জন্য জনাব ভুট্টোও ঢাকায় আসেন। ২৪ মার্চ পর্যন্ত ইয়াহিয়া-মুজিব-ভুট্টো আলোচনা হয়। ২৫ মার্চ আলোচনা ব্যর্থ হবার পর সন্ধ্যায় ইয়াহিয়া ঢাকা ত্যাগ করেন। ২৫ মার্চ দিবাগত রাতে নিরীহ নিরস্ত্র বাঙালির ওপর পাকিস্তান সেনাবাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়ে। আক্রমণ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, পিলখানা রাইফেল সদর দফতর ও রাজারবাগ পুলিশ হেড কোয়ার্টার। বঙ্গবন্ধু ২৫শে মার্চ রাত ১২টা ২০ মিনিটে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন :

“This may be my last message, from to-day Bangladesh is independent. I call upon the people of Bangladesh wherever you might be and with whatever you have, to resist the army of occupation to the last. Your fight must go on until the last soldier of the Pakistan occupation army is expelled from the soil of Bangladesh and final victory is achieved.”

[অনুবাদ : ‘এটাই হয়ত আমার শেষ বার্তা, আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। বাংলাদেশের জনগণ, তোমরা যে যেখানেই আছ এবং যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শেষ পর্যন্ত দখলদার সৈন্য বাহিনীকে প্রতিরোধ করার জন্য আমি তোমাদের আহবান জানাচ্ছি। পাকিস্তান দখলদার বাহিনীর শেষ সৈনেকটিকে বাংলাদেশের মাটি থেকে বিতাড়িত করে চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত, তোমাদের যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হবে।’] এই ঘোষণা বাংলাদেশের সর্বত্র ওয়্যারলেস, টেলিফোন ও ট্রেলিগ্রামের মাধ্যমে প্রেরিত হয়।

এর সঙ্গে সঙ্গেই তিনি বাংলায় নিম্নলিখিত একটি বার্তা পাঠান:

“পাকিস্তান সেনাবাহিনী অতর্কিতভাবে পিলখানা ইপিআর ঘাঁটি, রাজারবাগ পুলিশ লাইন আক্রমণ করেছে এবং শহরের রাস্তায় রাস্তায় যুদ্ধ চলছে, আমি বিশ্বের জাতিসমূহের কাছে সাহায্যের আবেদন করছি। আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা বীরত্বের সঙ্গে মাতৃভূমি মুক্ত করার জন্য শত্রুদের সঙ্গে যুদ্ধ করছে। সর্বশক্তিমান আল্লাহর নামে আপনাদের কাছে আমার আবেদন ও আদেশ দেশকে স্বাধীন করার জন্য শেষ রক্তবিন্দু থাকা পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যান। আপনাদের পাশে এসে যুদ্ধ করার জন্য পুলিশ, ইপিআর, বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও আনসারদের সাহায্য চান। কোন আপোষ নাই। জয় আমাদের হবেই। পবিত্র মাতৃভূমি থেকে শেষ শত্রুকে বিতাড়িত করুন। সকল আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী এবং অন্যান্য দেশপ্রেমিক প্রিয় লোকদের কাছে এ সংবাদ পৌঁছে দিন। আল্লাহ আপনাদের মঙ্গল করুন। জয় বাংলা।”

বঙ্গবন্ধুর এই বার্তা তাৎক্ষণিকভাবে বিশেষ ব্যবস্থায় সারাদেশে পাঠানো হয়। সর্বস্তরের জনগণের পাশাপাশি চট্টগ্রাম, কুমিল্লা ও যশোর সেনানিবাসে বাঙালি জওয়ান ও অফিসাররা প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। পাকিস্তান সেনাবাহিনী ১:৩০ মিনিটে বঙ্গবন্ধুকে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাসভবন থেকে গ্রেফতার করে ঢাকা সেনানিবাসে নিয়ে যায় এবং এর তিন দিন পর তাকে বন্দি অবস্থায় পাকিস্তান নিয়ে যাওয়া হয়। ২৬শে মার্চ জে. ইয়াহিয়া এক ভাষণে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে বঙ্গবন্ধুকে দেশদ্রোহী বলে আখ্যায়িত করে।

২৬ মার্চ চট্টগ্রাম স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ নেতা এম. এ. হান্নান বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণাপত্রটি পাঠ করেন। ১০ এপ্রিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি করে বিপ্লবী সরকার গঠিত হয়। ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলার আম্রকাননে (মুজিবনগর) বাংলাদেশ সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়। বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রপতি, সৈয়দ নজরুল ইসলাম অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি এবং তাজউদ্দিন আহমদ প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের পরিচালনায় মুক্তিযুদ্ধ শেষে ১৬ ডিসেম্বর ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে পাকিস্তানী বাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জিত হয়। বাংলাদেশ লাভ করে স্বাধীনতা। তার আগে ৭ সেপ্টেম্বর পাকিস্তানের ফায়জালাবাদ (লায়ালপুর) জেলে বঙ্গবন্ধুর গোপন বিচার করে তাকে দেশদ্রোহী ঘোষণা করে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা হয়। বিভিন্ন দেশ ও বিশ্বের মুক্তিকামী জনগণ বঙ্গবন্ধুর জীবনের নিরাপত্তার দাবি জানায়। ২৭ ডিসেম্বর বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে জাতির জনক রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে অবিলম্বে নিঃশর্ত মুক্তি প্রদানের দাবি জানান হয়। ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নসহ বিভিন্ন দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থার পক্ষ থেকে বঙ্গবন্ধুর মুক্তির জন্য পাকিস্তান সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলা হয়, শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি। তিনি বাংলাদেশের স্থপতি, কাজেই পাকিস্তানের কোন অধিকার নেই তাকে বন্দি করে রাখার। বাংলাদেশ ইতিমধ্যে বহু রাষ্ট্রের স্বীকৃতি লাভ করেছে।

১৯৭২
৮ জানুয়ারি পাকিস্তান সরকার আন্তর্জাতিক চাপে বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দেয়। জুলফিকার আলী ভুট্টো বঙ্গবন্ধুর সাথে সাক্ষাৎ করেন। সেদিনই বঙ্গবন্ধুকে ঢাকার উদ্দেশ্যে লন্ডন পাঠান হয়। ৯ জানুয়ারি লন্ডনে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হীথের সাথে সাক্ষাৎ হয়। লন্ডন থেকে ঢাকা আসার পথে বঙ্গবন্ধু দিল্লিতে যাত্রা বিরতি করেন। বিমানবন্দরে ভারতের রাষ্ট্রপতি ভি. ভি. গিরি ও প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধী বঙ্গবন্ধুকে স্বাগত জানান।

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু ১০ জানুয়ারি ঢাকায় পৌঁছালে তাকে অবিস্মরণীয় সংবর্ধনা জ্ঞাপন করা হয়। বঙ্গবন্ধু বিমান বন্দর থেকে সরাসরি রেসকোর্স ময়দানে গিয়ে লক্ষ জনতার সমাবেশ থেকে অশ্রুসিক্ত নয়নে জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেন। ১২ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ৬ ফেব্রুয়ারি ভারত সরকারের আমন্ত্রণে তিনি ভারত যান। ২৮ ফেব্রুয়ারি তিনি সোভিয়েত ইউনিয়ন সফরে যান। ১২ মার্চ বঙ্গবন্ধুর অনুরোধে ভারতীয় মিত্র বাহিনী বাংলাদেশ ত্যাগ করে। ১ মে তিনি তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর সরকারি কর্মচারীদের বেতন বৃদ্ধির ঘোষণা দেন। ৩০ জুলাই লন্ডনে বঙ্গবন্ধুর পিত্তকোষে অস্ত্রোপচার করা হয়। অস্ত্রোপচারের পর লন্ডন থেকে তিনি জেনেভা যান। ১০ অক্টোবর বিশ্ব শান্তি পরিষদ বঙ্গবন্ধুকে ‘জুলিও কুরী’ পুরস্কারে ভূষিত করে। ৪ নভেম্বর বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের প্রথম সাধারণ নির্বাচনের তারিখ (৭ মার্চ ১৯৭৩) ঘোষণা করেন। ১৪ ডিসেম্বর বাংলাদেশের প্রথম সংবিধানে বঙ্গবন্ধু স্বাক্ষর করেন। ১৫ ডিসেম্বর বঙ্গবন্ধু সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের রাষ্ট্রীয় খেতাব প্রদানের কথা ঘোষণা করেন। ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের সংবিধান কার্যকর হয়। প্রশাসনিক ব্যবস্থার পুনর্গঠন, সংবিধান প্রণয়ন, এক কোটি মানুষের পুনর্বাসন, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন, শিক্ষা ব্যবস্থার সম্প্রসারণ, শিক্ষার্থীদের জন্য প্রাথমিক স্কুল পর্যন্ত বিনামূল্যে এবং মাধ্যমিক শ্রেণী পর্যন্ত নামমাত্র মূল্যে পাঠ্যপুস্তক সরবরাহ, মদ, জুয়া, ঘোড়দৌড়সহ সমস্ত ইসলাম বিরোধী কর্মকাণ্ড কার্যকরভাবে নিষিদ্ধকরণ, ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা, মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড পুনর্গঠন, ১১০০০ প্রাথমিক স্কুল প্রতিষ্ঠাসহ ৪০,০০০ প্রাথমিক স্কুল সরকারীকরণ, মুক্তিযুদ্ধে পাকবাহিনীর হাতে নির্যাতিত মেয়েদের পুনর্বাসেনের জন্য নারী পুনর্বাসন সংস্থা, মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট গঠন, ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা মাফ, বিনামূল্যে/স্বল্পমূল্যে কৃষকদের মধ্যে কৃষি উপকরণ বিতরণ, পাকিস্তানিদের পরিত্যক্ত ব্যাংক, বীমা ও ৫৮০টি শিল্প ইউনিটের জাতীয়করণ ও চালু করার মাধ্যমে হাজার হাজার শ্রমিক-কর্মচারীর কর্মসংস্থান, ঘোড়াশাল সার কারখানা, আশুগঞ্জ কমপ্লেক্স এর প্রাথমিক কাজ ও অন্যান্য নতুন শিল্প স্থাপন, বন্ধ শিল্প-কারখানা চালুকরণসহ অন্যান্য সমস্যার মোকাবেলা করে একটি সুষ্ঠু পরিকল্পনার মাধ্যমে অর্থনৈতিক অবকাঠামো তৈরি করে দেশকে ধীরে ধীরে একটি সমৃদ্ধিশালী রাষ্ট্রে পরিণত করার প্রয়াস চালানো হয়। অতি অল্প সময়ে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক রাষ্ট্রের স্বীকৃতি লাভ ছিল বঙ্গবন্ধু সরকারের উল্লেখযোগ্য সাফল্য।

১৯৭৩
জাতীয় সংসদের প্রথম নির্বাচনে ৩০০ আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগের ২৯৩ আসন লাভ। ৩ সেপ্টেম্বর আওয়ামী লীগ, সিপিবি ও ন্যাপের সমন্বয়ে ঐক্য-ফ্রন্ট গঠিত হয়। ৬ সেপ্টেম্বর জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের শীর্ষ সম্মেলনে যোগদানের জন্য বঙ্গবন্ধু আলজেরিয়া যান। ১৭ অক্টোবর তিনি জাপান সফর করেন।

১৯৭৪
২২ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশকে পাকিস্তান স্বীকৃতি দেয়। ২৩ ফেব্রুয়ারি ইসলামী সম্মেলন সংস্থা (ওআইসি) এর শীর্ষ সম্মেলনে যোগদানের উদ্দেশ্যে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান গমন করেন। ১৭ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভ করে এবং বঙ্গবন্ধু ২৫ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে প্রথমবারের মতো বাংলায় ভাষণ দেন।

১৯৭৫
২৫ জানুয়ারি রাষ্ট্রপতি পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন এবং বঙ্গবন্ধুর রাষ্ট্রপতির দায়িত্বভার গ্রহণ। ২৪ ফেব্রুয়ারি দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ে জাতীয় দল বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ গঠন। বঙ্গবন্ধু জাতীয় দলে যোগদানের জন্য দেশের সকল রাজনৈতিক দল ও নেতাদের প্রতি আহ্বান জানান। বিদেশী সাহায্যের উপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে বাঙালি জাতিকে আত্মনির্ভরশীল হিসাবে গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন। তাই স্বাবলম্বিতা অর্জনের লক্ষ্যে অর্থনৈতিক নীতিমালাকে নতুনভাবে ঢেলে সাজান। স্বাধীনতাকে অর্থবহ করে মানুষের আহার, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষা ও কাজের সুযোগ সৃষ্টির লক্ষ্যে দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি ঘোষণা দেন যার লক্ষ্য ছিল- দুর্নীতি দমন; ক্ষেতে খামারে ও কলকারখানায় উৎপাদন বৃদ্ধি; জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ এবং জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা। এই লক্ষ্যে দ্রুত অগ্রগতি সাধিত করবার মানসে ৬ জুন বঙ্গবন্ধু সকল রাজনৈতিক দল, পেশাজীবী, বুদ্ধিজীবী মহলকে ঐক্যবদ্ধ করে এক মঞ্চ তৈরি করেন, যার নাম দেন বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ। বঙ্গবন্ধু এই দলের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন।

সমগ্র জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে অর্থনৈতিক মুক্তির সংগ্রামে অংশগ্রহণের আহ্বান জানিয়ে অভূতপূর্ব সাড়া পান। অতি অল্প সময়ের মধ্যে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি হতে শুরু করে। উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। চোরাকারবারি বন্ধ হয়। দ্রব্যমূল্য সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার আওতায় চলে আসে। নতুন আশার উদ্দীপনা নিয়ে স্বাধীনতার সুফল মানুষের ঘরে ঘরে পৌঁছে দেবার জন্য দেশের মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়ে অগ্রসর হতে শুরু করে। কিন্তু মানুষের সে সুখ বেশি দিন স্থায়ী হয় না। ১৫ আগস্টের ভোরে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বাংলাদেশের স্থপতি বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিজ বাসভবনে সেনাবাহিনীর কতিপয় উচ্চাভিলাষী বিশ্বাসঘাতক অফিসাদের হাতে নিহত হন। সেদিন বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণী মহীয়সী নারী বেগম ফজিলাতুননেছা, বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ পুত্র মুক্তিযোদ্ধা লে. শেখ কামাল, পুত্র লে. শেখ জামাল, কনিষ্ঠ পুত্র শেখ রাসেল, দুই পুত্রবধূ সুলতানা কামাল ও রোজী জামাল, বঙ্গবন্ধুর ভাই শেখ নাসের, ভগ্নীপতি ও কৃষিমন্ত্রী আবদুর রব সেরনিয়াবাত ও তার কন্যা বেবি সেরনিয়াবাত, পুত্র আরিফ সেরনিয়াবাত, দৌহিত্র সুকান্ত আবদুল্লাহ বাবু, ভ্রাতুষ্পুত্র শহীদ সেরনিয়াবাত, বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে যুবনেতা ও সাংবাদিক শেখ ফজলুল হক মনি ও তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী আরজু মনি, বঙ্গবন্ধুর সামরিক সচিব কর্নেল জামিল আহমেদ এবং ১৪ বছরের কিশোর আবদুল নঈম খান রিন্টুসহ ১৬ জনকে ঘাতকরা হত্যা করে।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট মহামানব বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শহীদ হবার পর দেশে সামরিক শাসন জারি হয়। গণতন্ত্রকে হত্যা করে মৌলিক অধিকার কেড়ে নেয়া হয়। শুরু হয় হত্যা, ক্যু ও ষড়যন্ত্রের রাজনীতি। কেড়ে নেয় জনগণের ভাত ও ভোটের অধিকার। বিশ্বে মানবাধিকার রক্ষার জন্য হত্যাকারীদের বিচারের বিধান রয়েছে কিন্তু বাংলাদেশে জাতির জনকের আত্মস্বীকৃত খুনিদের বিচারের হাত থেকে রেহাই দেবার জন্য ২৬শে সেপ্টেম্বর এক সামরিক অধ্যাদেশ (ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স) জারি করা হয়। জেনারেল জিয়াউর রহমান সামরিক শাসনের মাধ্যমে অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করে পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স নামে এক কুখ্যাত কালো আইন সংবিধানে সংযুক্ত করে সংবিধানের পবিত্রতা নষ্ট করে। খুনিদের বিদেশে অবস্থিত বিভিন্ন দূতাবাসে চাকরি দিয়ে পুরস্কৃত করে।

১৯৯৬ সালের ২৩ জুন বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ গঠন করার পর ২ অক্টোবর ধানমন্ডি থানায় তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ তার পরিবারের সদস্যগণকে হত্যার বিরুদ্ধে এজাহার দায়ের করা হয়। ১২ নভেম্বর জাতীয় সংসদে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল করা হয়। ১ মার্চ ’৯৭ ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ আদালতে বিচারকার্য শুরু হয়। ৮ নভেম্বর ’৯৮ ১৫ জনকে মৃত্যুদন্ড প্রদান করে রায় ঘোষণা করা হয়। ২০১০ সালের ২৮ জানুয়ারি মধ্যরাতে পাঁচ ঘাতকের মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়। ঘাতকদের একজন বিদেশে পলাতক অবস্থায় মারা গেছে এবং ছয়জন বিদেশে পলাতক রয়েছে।

১৫ আগস্ট জাতির জীবনে এক কলঙ্কময় দিন। এই দিবসটি জাতীয় শোক দিবস হিসাবে বাঙালি জাতি পালন করে।

                                                                                                                                                                                                                                                                                           তথ্যসূত্র : ১)      অসমাপ্ত আত্মজীবনী

                                                                                                                                                                                                                                                                                                         ২)        মুজিবপিডিয়া

বেগম ফজিলাতুননেছা মুজিব

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সহধর্মিণী, বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুননেছা মুজিবের জন্ম ১৯৩০ সালের ৮ আগস্ট, তৎকালীন ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জ মহকুমার টুঙ্গিপাড়া গ্রামে। বাবা শেখ জহুরুল হক এবং মা হোসনে আরা বেগম। দুই মেয়ের মধ্যে তিনি দ্বিতীয়। ফজিলাতুন নেছার গায়ের রং ছিলো সুন্দর, এ কারণে মা আদর করে তাঁকে রেণু বলে ডাকতেন। রেণুর বয়স যখন তিন বছর তখন তাঁর বাবা মারা যান। পিতার মৃত্যুর দুই বছর পর তিনি মাকেও হারান। ফজিলাতুন নেছা সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুর চাচাতো বোন। খুব অল্প বয়সেই তাঁদের বিয়ে হয়।

১৯৪৭ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর টুঙ্গিপাড়ায় ফজিলাতুননেছা রেণুর কোল জুড়ে প্রথম যে সন্তানের জন্ম- তিনি শেখ হাসিনা। কন্যার জন্মের কথা শুনলেও সঙ্গে সঙ্গে শেখ মুজিব বাড়িতে আসতে পারেননি। এর দু'বছর পর বড় ছেলে শেখ কামালের জন্ম হয়। এ সময়গুলোতে শেখ মুজিব নিয়মিত পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থার নজরদারিতে থাকতেন। কখনোবা রাজনৈতিক কারণে তাঁকে কারাবন্দি থাকতে হতো। সন্তানদের লালন-পালন, পড়াশোনা সবকিছুই সামলাতে হতো ফজিলাতুননেছা রেণুকে। তিনি তখন টুঙ্গিপাড়াতেই থাকতেন। শেখ জামালের জন্মও সেখানে, ১৯৫৩ সালের ২৮ এপ্রিল। এরপর ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনে শেখ মুজিবুর রহমান প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হলে স্বামীর কর্মকাণ্ডে সহায়তা করার জন্য তিনি তিন সন্তানকে নিয়ে ঢাকায় চলে আসেন। ১৯৬১ সালের অক্টোবর মাসে তাঁরা ধানমন্ডি ৩২ নম্বর রোডের বাড়িতে চলে আসেন। এখানেই ১৯৬৪ সালের ১৮ অক্টোবর শেখ রাসেলের জন্ম হয়।

১৯৬৮ সালে বঙ্গবন্ধু যখন ষড়যন্ত্রমূলক আগরতলা মামলায় কারাবন্দি, সে-বছর ১৭ নভেম্বর শেখ মুজিবের সম্মতিতে বড় মেয়ে শেখ হাসিনার সাথে এমএ ওয়াজেদ মিয়ার আক্দ হয়। সে-সময় ফজিলাতুননেছা একাই সব সামলান। বিয়ের পরদিন জেলগেটে শেখ মুজিবের সঙ্গে নব-দম্পতির দেখা করার ব্যবস্থা করেন।

শেখ মুজিবের 'বঙ্গবন্ধু' হয়ে ওঠার পেছনে ফজিলাতুননেছার রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। সংসার সামলানোর পাশাপাশি কারাগারে গিয়ে স্বামীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাঁর মনোবল দৃঢ় রাখতেন। অন্যদিকে আইনজীবীদের বাড়ি-বাড়ি গিয়ে মামলার খোঁজখবর নিতেন। নিজের সোনার অলংকার বিক্রি করেও মামলার খরচ জুগিয়েছেন। নিজেকে বঞ্চিত করে তিনি স্বামীর আদর্শ ও সংগঠনের জন্য নিজের অনেক সম্বল বিলিয়ে দেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, তাঁর স্বামী দেশের জন্য, মানুষের কল্যাণের জন্য কাজ করছেন।

শেখ মুজিবের অনুপস্থিতির সময় আওয়ামী লীগকে শক্তিশালী করতে তিনি নীরবে নানা ভূমিকা পালন করে গেছেন। প্রকাশ্য প্রচারে কখনোই আসেননি। ছয় দফা কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে ১৯৬৬ সালের ৯ মে শেখ মুজিবকে নিরাপত্তা আইনে গ্রেপ্তার করা হয়। সে-বছর আওয়ামী লীগের বহু রাজনৈতিক নেতাকেও একই কারণে গ্রেপ্তার করা হয়। তাঁদের মুক্তির জন্য আন্দোলন গড়ে তুলতে বেগম মুজিব বিশেষ ভূমিকা রাখেন। রাজনৈতিক নেতাদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে তিনি ৭ জুন আওয়ামী লীগের হরতাল সফল করতে উদ্যোগ নেন।

রাজনৈতিক জীবনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় বঙ্গমাতা ছিলেন বঙ্গবন্ধুর পাশে। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে 'অপারেশন বিগ বার্ড' নামের সামরিক অভিযানের মাধ্যমে পাকিস্তানিরা আটক করে বঙ্গবন্ধুকে। এর আগে ৩২ নম্বরের বাড়ি ছেড়ে ছেলেমেয়েদের নিয়ে পাশের বাড়িতে আত্মগোপন করেন বঙ্গমাতা। নিরাপত্তার কারণে একে একে ১৯ বার বাসা পরিবর্তন করে বঙ্গবন্ধুর পরিবার। তা সত্ত্বেও ১২ মে তাঁরা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কাছে ধরা পড়েন। ধানমণ্ডির ১৮ নম্বর রোডের ২৬ নম্বর বাড়িতে বেগম ফজিলাতুননেছা মুজিবের পাশাপাশি অবরুদ্ধ ছিলেন শেখ হাসিনা, শেখ জামাল, শেখ রেহানা, শেখ রাসেল ও শেখ হাসিনার স্বামী এমএ ওয়াজেদ মিয়া। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু দেশ গড়ার কাজে আত্মনিয়োগ করলে তিনিও নীরবে বঙ্গবন্ধুর পাশে থেকে নিভৃতে কাজ করে গেছেন। যুদ্ধে স্বামী হারানো বিধবা মেয়েদের এবং নির্যাতনের শিকার অনেক বীরাঙ্গনা মেয়েকে তিনি নিজ দায়িত্বে বিয়ের ব্যবস্থা করেন।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ঘাতকের নির্মম বুলেটে বঙ্গবন্ধুসহ পরিবাররের অন্যান্য সদস্যদের সাথে বঙ্গমাতাও শাহাদাত বরণ করেন। শেখ পরিবারের সাতজন সদস্যের কবর আছে বনানীতে। প্রথম কবরটা বেগম মুজিবের।

বাঙালির মুক্তিসংগ্রামে ফজিলাতুননেছা মুজিবের রয়েছে অপরিসীম অবদান। বঙ্গমাতা ছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য সহধর্মিণী ও বাঙালির স্বাধীনতা অর্জনে নেপথ্যের কারিগর। বঙ্গমাতার অবদান চিরস্মরণীয় করতে 'বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব' পদক চালু করেছে বাংলাদেশ সরকার। রাজনীতি, অর্থনীতি, শিক্ষা, সংস্কৃতি ও ক্রীড়া, সমাজসেবা, স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধ, গবেষণা, কৃষি ও পল্লী উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান ও গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকার জন্য ২০২১ সাল থেকে প্রতি বছর পাঁচজন বাংলাদেশি নারীকে এই পদক দেয়ার ঘোষণা দেয়া হয়েছে। প্রতি বছর ৮ আগস্ট বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুননেছা মুজিবের জন্মদিবস উপলক্ষে আয়োজিত জাতীয় দিবসের অনুষ্ঠানে মনোনীত নারীদের এই পদক দেয়া হয়।

ফজিলাতুননেছা মুজিবের নামানুসারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় 'বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুননেছা হল'। জামালপুর জেলায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ‘বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়’। গোপালগঞ্জ জেলায় বঙ্গমাতার নাম অনুসারে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে ‘শেখ ফজিলাতুননেছা মুজিব চক্ষু হাসপাতাল ও প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান, গোপালগঞ্জ’।

                                                                                                                                                                                                                                                                                                       তথ্যসূত্র :    মুজিবপিডিয়া


শেখ হাসিনা

২০২৪ সালের ০৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪-দলীয় জোট নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করে। ১১ জানুয়ারি আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা টানা চতুর্থবারসহ পঞ্চমবারের মতো গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসাবে শপথ গ্রহণ করেন।

২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তাঁর দল আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জনের পর ৭ জানুয়ারি ২০১৯ শেখ হাসিনা চতুর্থবারের মত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন।

এর আগে শেখ হাসিনা ১৯৯৬-২০০১ মেয়াদে প্রথমবার, ২০০৯-২০১৩ মেয়াদে দ্বিতীয়বার এবং ২০১৪-২০১৮ মেয়াদে তৃতীয়বারের মত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। শেখ হাসিনা চতুর্থ, পঞ্চম ও অষ্টম জাতীয় সংসদের বিরোধী দলের নেতা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ভোটারবিহীন নির্বাচনের পর শেখ হাসিনার নেতৃত্বে গণআন্দোলনের মুখে খালেদা জিয়ার সরকার ১৫ দিনের মাথায় ৩০ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৬ পদত্যাগে বাধ্য হয়।

মৌলবাদ, জঙ্গিবাদ এবং সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলায় শেখ হাসিনা সব সময়ই আপোষহীন। ২০০৯ সালে সরকার পরিচালনায় দায়িত্ব নিয়ে তাঁর সরকার ১৯৭১ সালে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল স্থাপনের জন্য আইন প্রণয়ন করে। এই আইনের আওতায় স্থাপিত ট্রাইবুনাল যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু করেছে এবং রায় কার্যকর করা হচ্ছে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও বেগম ফজিলাতুননেসা মুজিবের ৫ সন্তানের মধ্যে জ্যেষ্ঠ শেখ হাসিনা। গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়ায় ১৯৪৭ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর তিনি জন্মগ্রহণ করেন।

শেখ হাসিনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৭৩ সালে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি বাংলাদেশ ছাত্রলীগের প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে সরকারি ইন্টামেডিয়েট গার্লস কলেজের ছাত্রী সংসদের সহসভাপতি ছিলেন। তিনি এই কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক এবং পরের বছর সভাপতি ছিলেন। শেখ হাসিনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের একজন সদস্য এবং ছাত্রলীগের রোকেয়া হল শাখার সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ছাত্রজীবন থেকেই শেখ হাসিনা সকল গণআন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে পরিবারের অধিকাংশ সদস্যসহ নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। শেখ হাসিনা ও তাঁর ছোটবোন শেখ রেহানা সে সময় পশ্চিম জার্মানিতে অবস্থান করায় বেঁচে যান। পরবর্তীকালে তিনি রাজনৈতিক আশ্রয়ে ৬ বছর ভারতে অবস্থান করেন। ১৯৮০ সালে ইংল্যান্ডে থেকে তিনি স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন শুরু করেন।

১৯৮১ সালে শেখ হাসিনার অনুপস্থিতিতে তাঁকে সর্বসম্মতিক্রমে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। ছয় বছরের নির্বাসিত জীবন শেষ করে অবশেষে তিনি ১৯৮১ সালের ১৭ মে দেশে ফিরে আসেন।

১৯৮১ সালে দেশে ফিরে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের সংগ্রামে লিপ্ত হওয়ার পরপরই তিনি শাসকগোষ্ঠির রোষানলে পড়েন। তাঁকে বারবার কারান্তরীণ করা হয়। তাঁকে হত্যার জন্য কমপক্ষে ১৯ বার সশস্ত্র হামলা করা হয়।

১৯৮৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি সামরিক সরকার তাঁকে আটক করে ১৫ দিন অন্তরীণ রাখে। ১৯৮৪ সালের ফেব্রুয়ারি এবং নভেম্বর মাসে তাঁকে দু’বার গৃহবন্দি করা হয়। ১৯৮৫ সালের ২মার্চ তাঁকে আটক করে প্রায় ৩ মাস গৃহবন্দি করে রাখা হয়। ১৯৮৬ সালের ১৫ অক্টোবর থেকে তিনি ১৫ দিন গৃহবন্দি ছিলেন। ১৯৮৭ সালে ১১ নভেম্বর তাঁকে গ্রেফতার করে এক মাস অন্তরীণ রাখা হয়। ১৯৮৯ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি শেখ হাসিনা গ্রেফতার হয়ে গৃহবন্দি হন। ১৯৯০ সালে ২৭ নভেম্বর শেখ হাসিনাকে বঙ্গবন্ধু ভবনে অন্তরীণ করা হয়। ২০০৭ সালের ১৬ জুলাই সামরিক বাহিনী সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার তাঁকে গ্রেফতার করে সংসদ ভবন চত্বরে সাবজেলে পাঠায়। প্রায় ১ বছর পর ২০০৮ সালের ১১ জুন তিনি মুক্তিলাভ করেন।

শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশে উল্লেখযোগ্য হামলাগুলোর মধ্যে রয়েছে ১৯৮৭ সালের ১০ নভেম্বর সচিবালয় ঘেরাও কর্মসূচি পালনকালে তাঁকে লক্ষ করে পুলিশের গুলিবর্ষণ। এতে যুবলীগ নেতা নূর হোসেন, বাবুল ও ফাত্তাহ নিহত হন। জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে তাঁকেসহ তাঁর গাড়ি ক্রেন দিয়ে তুলে নেওয়ার চেষ্টা করা হয়। ১৯৮৮ সালের ২৪ জানুয়ারি চট্টগ্রাম কোর্ট বিল্ডিংয়ের সামনে শেখ হাসিনাকে লক্ষ করে এরশাদ সরকারের পুলিশ বাহিনী লাঠিচার্জ ও গুলিবর্ষণ করে। এ ঘটনায় শেখ হাসিনা অক্ষত থাকলেও ৩০ জন আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী শহিদ হন। লালদীঘি ময়দানে ভাষণদানকালে তাঁকে লক্ষ্য করে ২বার গুলি বর্ষণ করা হয়। জনসভা শেষে ফেরার পথে আবারও তাঁর গাড়ি লক্ষ করে গুলি বর্ষণ করা হয়।

১৯৯১ সালে বিএনপি সরকার গঠনের পর শেখ হাসিনাকে হত্যার জন্য বারবার হামলা করা হয়। ১৯৯১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর জাতীয় সংসদের উপ-নির্বাচন চলাকালে তাঁকে লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণ করা হয়। ১৯৯৪ সালে ঈশ্বরদী রেল স্টেশনে তাঁর কামরা লক্ষ করে অবিরাম গুলিবর্ষণ করা হয়। ২০০০ সালে কোটালীপাড়ায় হেলিপ্যাডে এবং তাঁর জনসভাস্থলে ৭৬ কেজি ও ৮৪ কেজি ওজনের দু’টি বোমা পুতে রাখা হয়। শেখ হাসিনা পৌঁছার পূর্বেই বোমাগুলো সনাক্ত হওয়ায় তিনি প্রাণে বেঁচে যান। বিএনপি সরকারের সময় সবচেয়ে প্রাণঘাতী হামলা হয় ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট। ঐদিন বঙ্গবন্ধু এভিন্যুয়ে এক জনসভায় বক্তব্য শেষ করার পরপরই তাঁকে লক্ষ্য করে এক ডজনেরও বেশি আর্জেস গ্রেনেড ছোঁড়া হয়। লোমহর্ষক সেই হামলায় শেখ হাসিনা প্রাণে রক্ষা পেলেও আইভি রহমানসহ তাঁর দলের ২২ নেতাকর্মী নিহত হন এবং ৫ শ’র বেশি মানুষ আহত হন। শেখ হাসিনা নিজেও কানে আঘাত পান।

শত বাধা-বিপত্তি এবং হত্যার হুমকিসহ নানা প্রতিকূলতা উপেক্ষা করে শেখ হাসিনা ভাত-ভোট এবং সাধারণ মানুষের মৌলিক অধিকার আদায়ের জন্য অবিচল থেকে সংগ্রাম চালিয়ে গেছেন। তাঁর নেতৃত্বে বাংলাদেশের জনগণ অর্জন করেছে গণতন্ত্র ও বাক-স্বাধীনতা। বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত হতে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা পেয়েছে।

শেখ হাসিনার শাসনামলে আর্থ-সামাজিক খাতে দেশ অভূতপূর্ব অগ্রগতি অর্জন করে। ১৯৯৬-২০০১ মেয়াদে শেখ হাসিনা সরকারের উল্লেখযোগ্য সাফল্যগুলো ছিল: ভারতের সঙ্গে সাথে ৩০ বছর মেয়াদী গঙ্গা নদীর পানি চুক্তি, পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তি, যমুনা নদীর উপর বঙ্গবন্ধু সেতু নির্মাণ এবং খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ং-সম্পূর্ণতা অর্জন। এছাড়া, তিনি কৃষকদের জন্য বিভিন্ন কল্যাণমূলক কর্মসূচি এবং ভূমিহীন, দুস্থ মানুষের জন্য সামাজিক নিরাপত্তামূলক কর্মসূচি চালু করেন। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল: দুস্থ মহিলা ও বিধবা ভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতা, মুক্তিযোদ্ধা ভাতা, বয়স্কদের জন্য শান্তি নিবাস, আশ্রয়হীনদের জন্য আশ্রয়ণ প্রকল্প এবং একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্প।

২০০৯-২০১৩ মেয়াদে শেখ হাসিনা সরকারের উল্লেখযোগ্য অর্জনগুলোর মধ্যে রয়েছে বিদ্যুতের উৎপাদন ক্ষমতা ১৩,২৬০ মেগাওয়াটে উন্নীতকরণ, গড়ে ৬ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি অর্জন, ৫ কোটি মানুষকে মধ্যবিত্তে উন্নীতকরণ, ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে সামুদ্রিক জলসীমা বিরোধের নিষ্পত্তি, প্রতিটি ইউনিয়নে ডিজিটাল সেন্টার স্থাপন, মাধ্যমিক পর্যায় পর্যন্ত সকল শিক্ষার্থীর মধ্যে বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক বিতরণ, কৃষকদের জন্য কৃষিকার্ড এবং ১০ টাকায় ব্যাংক হিসাব খোলা, বিনা জামানতে বর্গাচাষীদের ঋণ প্রদান, চিকিৎসাসেবার জন্য সারা দেশে প্রায় সাড়ে ১৬ হাজার কম্যুনিটি ক্লিনিক এবং ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্র স্থাপন, দারিদ্র্যের হার ২০০৬ সালের ৩৮.৪ থেকে ২০১৩-১৪ বছরে ২৪.৩ শতাংশে হ্রাস, জাতিসংঘ কর্তৃক শেখ হাসিনার শান্তির মডেল গ্রহণ, ইত্যাদি।

২০১৪-২০১৮ মেয়াদে উল্লেখযোগ্য সাফল্যগুলোর মধ্যে রয়েছে: বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীতকরণ, ভারতের পার্লামেন্ট কর্তৃক স্থল সীমানা চুক্তির অনুমোদন এবং দুই দেশ কর্তৃক অনুসমর্থন, (এরফলে দুই দেশের মধ্যে ৬৮ বছরের সীমানা বিরোধের অবসান হয়েছে), মাথাপিছু আয় ১,৬০২ মার্কিন ডলারে উন্নীতকরণ, দারিদ্র্যের হার ২২.৪ শতাংশে হ্রাস, ৩২ বিলিয়ন ডলারের উপর বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, পদ্মা সেতুর বাস্তবায়ন শুরু, মহাকাশে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ উৎক্ষেপন ইত্যাদি।

চতুর্থ মেয়াদে এ পর্যন্ত অর্জিত উল্লেখযোগ্য অর্জনগুলোর মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশকে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়ন দেশের কাতারে অন্তভুক্তিকরণ, নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজ সমাপ্ত এবং ঢাকায় মেট্রোরেলের পরীক্ষামূলক চলাচল শুরু। রাজধানী ঢাকার সঙ্গে বেশ কয়েকটি জেলা শহরের সংযোগ সড়ক চার-লেনে উন্নীত করা হয়েছে। রূপপুরে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ, চট্টগ্রামে কর্ণফুলী নদীর তলদেশে টানেল নির্মাণ, মাতারবাড়ি বহুমুখী প্রকল্পসহ বিভিন্ন মেগা প্রকল্পের বাস্তবায়নের কাজ দ্রুত এগিয়ে চলছে। সারাদেশে ১০০টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল নির্মিত হচ্ছে। সবগুলি বিভাগে আইসিটি পার্ক নির্মাণের কাজ চলছে। বর্তমানে মাথাপিছু আয় ২৮২৪ মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়েছে।

শান্তি প্রতিষ্ঠা, গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপদান এবং আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে অসামান্য অবদান রাখার জন্য বিশ্বের বেশকিছু বিশ্ববিদ্যালয় এবং প্রতিষ্ঠান শেখ হাসিনাকে বিভিন্ন ডিগ্রি এবং পুরস্কার প্রদান করে।

যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টন ইউনিভার্সিটি, ব্রিজপোর্ট বিশ্ববিদ্যালয় এবং ব্যারি বিশ্ববিদ্যালয়, জাপানের ওয়াসেদা বিশ্ববিদ্যালয়, স্কটল্যান্ডের অ্যাবারটে বিশ্ববিদ্যালয়, ভারতের বিশ্বভারতী এবং ত্রিপুরা বিশ্ববিদ্যালয়, অস্ট্রেলিয়ার ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, ব্রাসেলসের বিশ্ববিখ্যাত ক্যাথলিক বিশ্ববিদ্যালয়, রাশিয়ার পিপলস ফ্রেন্ডশিপ বিশ্ববিদ্যালয় এবং স্টেট ইউনিভার্সিটি অব পিটার্সবার্গ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি প্রদান করে। এছাড়া ফ্রান্সের ডাওফি বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ডিপ্লোমা প্রদান করে।

সামাজিক কর্মকাণ্ড, শান্তি ও স্থিতিশীলতার ক্ষেত্রে অসামান্য অবদানের জন্য শেখ হাসিনাকে বিশ্বের বিভিন্ন সংস্থা সম্মানিত করেছে।

পার্বত্য চট্টগ্রামে সুদীর্ঘ ২৫ বছরের গৃহযুদ্ধ অবসানের ক্ষেত্রে শেখ হাসিনার অসামান্য অবদানের জন্য ১৯৯৮ সালে ইউনেস্কো তাঁকে ‘হুপে-বোয়ানি’ (Houphouet-Boigny) শান্তি পুরস্কারে ভূষিত করে।

রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও মানবাধিকারের ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাহসিকতা ও দূরদর্শিতার জন্য যুক্তরাস্ট্রের রানডলপ ম্যাকন উইমেন্স কলেজ ২০০০ সালের ৯ এপ্রিল মর্যাদাসূচক ‘Pearl S. Buck ’৯৯’ পুরস্কারে ভূষিত করে। জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি ক্ষুধার বিরুদ্ধে আন্দোলনের অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ শেখ হাসিনাকে সম্মানজনক ‘সেরেস’ (CERES) মেডেল প্রদান করে। সর্বভারতীয় শান্তিসংঘ শেখ হাসিনাকে ১৯৯৮ সালে ‘মাদার টেরেসা’ পদক প্রদান করে। ১৯৯৮ সালে আন্তর্জাতিক রোটারি ফাউন্ডেশন তাঁকে Paul Haris ফেলোশিপ প্রদান করে। পশ্চিমবঙ্গ সর্বভারতীয় কংগ্রেস ১৯৯৭ সালে তাঁকে নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু স্মৃতি পদক প্রদান করে। আন্তর্জাতিক লায়ন্স ক্লাব কর্তৃক ১৯৯৬-১৯৯৭ সালে তিনি ‘Medal of Distinction’ পদক ও ১৯৯৬-১৯৯৭ সালে ‘Head of State’ পদক লাভ করেন। ২০০৯ সালে ভারতের ইন্দিরা গান্ধী মেমোরিয়াল ট্রাস্ট শান্তি ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় অসামান্য ভূমিকা পালনের জন্য শেখ হাসিনাকে ইন্দিরা গান্ধী পুরস্কারে ভূষিত করে। এছাড়া তিনি বৃটেনের গ্লোবাল ডাইভারসিটি পুরস্কার এবং ২ বার সাউথ সাউথ পুরস্কারে ভূষিত হন। ২০১৪ সালে ইউনেসকো তাঁকে ‘শান্তিরবৃক্ষ’ এবং ২০১৫ সালে উইমেন ইন পার্লামেন্টস গ্লোবাল ফোরাম নারীর ক্ষমতায়নের জন্য তাঁকে রিজিওনাল লিডারশীপ পুরস্কার এবং গ্লোবাল সাউথ-সাউথ ডেভলপমেন্ট এক্সপো-২০১৪ ভিশনারি পুরস্কারে ভূষিত করে। বাংলাদেশের কৃষির উন্নয়নে অব্যাহত সমর্থন, খাদ্য উৎপাদনে সয়ম্ভরতা অর্জন এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নয়নে অবদানের জন্য আমেরিকার কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয় ২০১৫ সালে তাঁকে সম্মাননা সনদ প্রদান করে।

জাতিসংঘ পরিবেশ উন্নয়ন কর্মসূচি দেশে এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পরিবেশ এবং টেকসই উন্নয়নে অসামান্য অবদান রাখার জন্য লিডারশীপ ক্যাটাগরিতে শেখ হাসিনাকে তাদের সর্বোচ্চ পুরস্কার ‘চ্যাম্পিয়ন অব দ্যা আর্থ-২০১৫’ পুরস্কারে ভূষিত করেছে। এছাড়া, টেকসই ডিজিটাল কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য International Telecommunication Union (ITU) শেখ হাসিনাকে ICTs in Sustainable Development Award-2015 প্রদান করে। নারী শিক্ষা ও উদ্যোক্তা তৈরিতে অসামান্য অবদানের জন্য তিনি ২৭ এপ্রিল ২০১৮ Global Women’s Leadership Award-এ ভূষিত হন। ইনস্টিটিউট অব সাউথ এশিয়ান উইমেন ২০১৯ সালে তাঁকে Lifetime Contribution for Women Empowerment Award প্রদান করে। এসিডিএসএন কর্তৃক তিনি ২০২১ সালে ‘এসডিজি অগ্রগতি’ পুরস্কারে ভূষিত হন।

২০২১ সালের নভেম্বরে Cop-26 সম্মেলনের সময় বিবিসি শেখ হাসিনাকে “The voice of the Vulnerable” হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। জাতিসংঘ এবং কমনওয়েলথ-এ দরিদ্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠিকে কমনওয়েলথ ও এসডিজি’র ভবিষ্যত অংশীদারিত্বের মূলধারায় নিয়ে আসতে তিনি শক্তিশালী নিয়ামকের ভূমিকা পালন করে চলেছেন।

শেখ হাসিনা বেশ কয়েকটি গ্রন্থের রচয়িতা। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে: ‘‘শেখ মুজিব আমার পিতা’’, ওরা টোকাই কেন?, বাংলাদেশে স্বৈরতন্ত্রের জন্ম’’, দারিদ্র্য বিমোচন, কিছু ভাবনা’’, ‘‘আমার স্বপ্ন, আমার সংগ্রাম’’, আমরা জনগণের কথা বলতে এসেছি’’, ‘‘সামরিকতন্ত্র বনাম গণতন্ত্র’’, ‘‘সাদা কালো’’, ‘‘সবুজ মাঠ পেরিয়ে’’,মুজিব বাংলার, বাংলা মুজিবের, Miles to Go, The Quest for Vision-2021 (two volumes) ইত্যাদি।

শেখ হাসিনা ‘‘জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান মেমোরিয়াল ট্রাস্ট’’ এর সভাপতি। তিনি গণতন্ত্র, ধর্ম নিরপেক্ষতা, সামগ্রিক প্রবৃদ্ধি ও অগ্রগতিতে বিশ্বাসী এবং দরিদ্র্য বিমোচনের মাধ্যমে জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জন তাঁর জীবনের অন্যতম লক্ষ্য । প্রযুক্তি, রান্না, সঙ্গীত এবং বই পড়ার প্রতি তাঁর বিশেষ আগ্রহ রয়েছে।

তাঁর স্বামী আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন পরমাণু বিজ্ঞানী ড. এম ওয়াজেদ মিয়া ২০০৯ সালের ৯ মে ইন্তেকাল করেন।

শেখ হাসিনার জ্যেষ্ঠ পুত্র সজীব আহমেদ ওয়াজেদ একজন তথ্য প্রযুক্তি বিশারদ। তাঁর একমাত্র কন্যা সায়মা হোসেন ওয়াজেদ একজন মনোবিজ্ঞানী এবং তিনি অটিস্টিক শিশুদের কল্যাণে কাজ করছেন। শেখ হাসিনার নাতি-নাতনীর সংখ্যা ৭ জন।


তথ্যসূত্র :          প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়


শেখ কামাল

বীর মুক্তিযোদ্ধা ক্যাপ্টেন শেখ কামাল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুননেছা মুজিব এঁর দ্বিতীয় সন্তান। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রথম ব্যাচের অফিসার শেখ কামালের জন্ম ১৯৪৯ সালের ৫ আগস্ট। শেখ কামালের নাম বঙ্গবন্ধু রেখেছিলেন আধুনিক তুরস্কের জনক বিপ্লবী রাজনীতিক, যোদ্ধা, লেখক এবং তুরস্কের প্রথম প্রেসিডেন্ট মোস্তফা কামাল আতাতুর্কের নামে।

ঢাকার সেগুনবাগিচার ডনস স্কুলে শুরু হয় তাঁর শিক্ষাজীবন। তিনি ঢাকার শাহীন স্কুল থেকে মাধ্যমিক এবং ঢাকা কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক উত্তীর্ণ হন। স্বাধীনতার পর শেখ কামাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের স্নাতকে (সম্মান) ভর্তি হন।

কিশোর বয়স থেকেই শেখ কামাল জড়িয়ে পড়েন পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও আন্দোলনে। ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান ও একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে তিনি বীরোচিত ভূমিকা পালন করেন। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ সন্ধ্যা থেকেই পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে তিনি আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষদের নিয়ে সাতমসজিদ সড়কে ও মিরপুর সড়কে গাছ কেটে ব্যারিকেড তৈরি করেছিলেন।

বাঙালির স্বাধীনতার মহান সংগ্রামে, মুক্তিবাহিনীর প্রথম ‘ওয়ার কোর্স’-এ ভারতের বিলোনিয়ায় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হয়ে কমিশন লাভ করেন এবং মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি জেনারেল এমএজি ওসমানীর ‘এডিসি’ বা ‘এইড-ডি-ক্যাম্প’ হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। বিজয় লাভের পর বীর মুক্তিযোদ্ধা ক্যাপ্টেন শেখ কামাল সেনাবাহিনী থেকে স্বেচ্ছায় অবসর নিয়ে শিক্ষাজীবনে ফিরে যান।

প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পাশাপাশি মাঠের সঙ্গেও সখ্য গড়ে ওঠে শেখ কামালের। মাত্র ২৬ বছরের জীবনে ক্রীড়াঙ্গন ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে সংগঠক হিসাবে অভাবনীয় দক্ষতা দেখান তিনি। নিজে খেলেছেন, আবাহনী ক্লাবও গড়েছেন। পাকিস্তান আমলে কোনো ক্লাবের এটাই প্রথম বাংলা নাম। শেখ কামালই বাংলাদেশের ফুটবলে আধুনিকতা যুক্ত করেন। ১৯৭৩ সালে শেখ কামাল কোচ হিসাবে আইরিশ ভদ্রলোক উইলিয়াম বিল হার্টকে নিয়োগ দেন। উইলিয়ামের হাত ধরেই ১৯৭৪ সালে ট্রফি জেতে আবাহনী। আবাহনীর একটি সার্কাস দলও ছিলো। ক্লাবের আয় নিশ্চিত করতে এই উদ্যোগ নিয়েছিলেন শেখ কামাল। ১৯৭৪-৭৫ মৌসুমে জাতীয় ক্রিকেট প্রতিযোগিতায় শেখ কামাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্রিকেট দলের হয়ে খেলেন। তিনি দলের সহ-অধিনায়ক ছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভলিবল ও ব্যাডমিন্টন খেলাতেও তাঁর উজ্জ্বল উপস্থিতি ছিল।

বীর মুক্তিযোদ্ধা ক্যাপ্টেন শেখ কামালের রাজনীতিতে সরব উপস্থিতি থাকলেও মঞ্চ নাটকের সাথে তিনি যুক্ত ছিলেন। ছিলেন ছায়ানটের ছাত্র। ওস্তাদ ফুল মোহাম্মদের কাছে ধানমন্ডির বাড়িতে সেতারে তালিম নিলেও পিয়ানোর প্রতি ছিলো তাঁর দারুন আগ্রহ। ১৯৭২ সালে পশ্চিবঙ্গে বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী মেলায় ডাকসু থেকে অংশগ্রহণকারী নাটক দলের সদস্য হিসাবে জর্জ বার্নার্ড শ’র লেখা থেকে শহীদ মুনীর চৌধুরীর অনুবাদে ‘কেউ কিছু বলতে পারে না’ নাটকটি মঞ্চস্থ করেন। তিনি নাটকটির প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেন। সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের বার্ষিক নাটকেও শেখ কামাল নিয়মিত অভিনয় করতেন।

শেখ কামাল ভালোবেসে বিয়ে করেন সে-সময়ে বাংলাদেশের সেরা নারী ক্রীড়াবিদ ও অ্যাথলেট সুলতানা কামালকে, যাকে প্রিয়জনরা ডাকতেন ‘খুকী’ নামে। বিয়ের এক মাসের মাথায় ১৫ আগস্ট সস্ত্রীক শাহাদাত বরণ করেন শেখ কামাল।

ঘাতকের বুলেটে শহীদ হওয়ার সময় তাঁর বয়স ছিল মাত্র ২৬ বছর। বনানীতে পাশাপাশি শেখ পরিবারের সাতজন সদস্যের কবর রয়েছে। তৃতীয় কবরটি শেখ কামালের।

২০২১ সালে শেখ কামালের জন্মবার্ষিকীকে ‘ক’ শ্রেণীভুক্ত দিবস হিসাবে ঘোষণা করে বাংলাদেশ সরকার। ‘শেখ কামাল ওয়াইল্ডলাইফ সেন্টার’ নামে গাজীপুরে বন ও বন্যপ্রাণী বিষয়ক একটি প্রশিক্ষণ ও গবেষণাকেন্দ্র গড়ে তোলা হয়েছে। এছাড়াও তাঁর নামে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ পুরস্কারের নামকরণ করা হয়েছে। গোপালগঞ্জ জেলায় ‘শেখ কামাল ক্রিকেট স্টেডিয়াম’ নামে একটি ক্রিকেট স্টেডিয়াম স্থাপন করা হয়েছে।


   তথ্যসূত্র :    মুজিবপিডিয়া

শেখ জামাল

বীর মুক্তিযোদ্ধা শেখ জামাল ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুননেছা মুজিব এঁর মেজো ছেলে। মিশরের জাতীয়তাবাদী ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী নেতা, পরবর্তীকালে দেশটির প্রেসিডেন্ট জামাল (মিশরীয় উচ্চারণ 'গামাল') আবদেল নাসেরের নামানুযায়ী বঙ্গবন্ধু তাঁর দ্বিতীয় পুত্রের নাম রেখেছিলেন শেখ জামাল। তিনি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রথম লংকোর্সে কমিশনপ্রাপ্ত অফিসার ছিলেন। ছিলেন ফুটবল ও ক্রিকেট খেলোয়াড়।

তাঁর জন্ম গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় ১৯৫৩ সালের ২৮ এপ্রিল। শেখ জামালের বয়স যখন দেড় বছর অর্থাৎ ১৯৫৪ সালের ডিসেম্বর থেকে ১৯৫৮ সাল পর্যন্ত শেখ মুজিবুর রহমান মুক্তজীবন কাটান। শেখ জামালের বেড়ে ওঠা এবং মানসিক জগৎ তৈরিতে শিশুকালে মা ফজিলাতুননেছা মুজিব এবং বড় বোন শেখ হাসিনার উল্লেখযোগ্য অবদান রয়েছে। মুজিব পরিবারের নানা স্মৃতিচারণে তাঁর কথা এসেছে। মুজিব পরিবারের চতুর্থ সন্তান শেখ রেহানা ও তাঁর বয়সের ব্যবধান কম থাকায় তাঁদের মধ্যে ছিলো খুনসুটির সম্পর্ক, যা নিয়ে শেখ রেহানাও স্মৃতিচারণ করেছেন নানান সময়ে। শেখ জামাল ঢাকা রেসিডেনসিয়াল মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে মাধ্যমিক এবং ঢাকা কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন। বন্ধুদের স্মৃতিচারণে কিশোর শেখ জামালের বিনয়ী অথচ স্বতঃস্ফূর্ত চরিত্রের কথা জানা যায়।

১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে তিনি কয়েকজন বন্ধুর সাথে ঢাকা থেকে প্রথমে ভারতের আগরতলা যান, সেখান থেকে কলকাতা হয়ে পৌঁছান উত্তর প্রদেশের কালশীতে। তিনি মুজিব বাহিনীর ৮০ জন নির্বাচিত তরুণের সঙ্গে ২১ দিনের বিশেষ প্রশিক্ষণ নিয়ে সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে এসে ৯ নম্বর সেক্টরে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন।

শেখ জামাল পারিবারিকভাবে বিয়ের বন্ধনে জড়িয়েছিলেন ফুপাতো বোন পারভীন জামাল রোজীর সঙ্গে। রোজী জামাল ছিলেন বঙ্গবন্ধুর সবচেয়ে ছোট বোন খোদেজা হোসেন লিলি ও সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ের সচিব এটিএম সৈয়দ হোসেনের পাঁচ সন্তানের মধ্যে সবচেয়ে ছোট। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট যাতকের বুলেটে জাতির পিতা এবং বঙ্গমাতাসহ পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের সাথে শাহাদত বরণ করেন শেখ জামাল এবং তার নবপরিণীতা বধূ পারভীন জামাল রোজী। বনানীতে পাশাপাশি শেখ পরিবারের সাতজন সদস্যের কবর রয়েছে। পঞ্চম কবরটি শেখ জামালের এবং ষষ্ঠ কবরটি তাঁর স্ত্রী পারভীন জামাল রোজীর।

২০১০ সালে শেখ জামালের নামে ধানমন্ডিতে “শেখ জামাল ধানমন্ডি ক্লাব” (বর্তমানে লে. শেখ জামাল ধানমন্ডি ক্লাব লিমিটেড) নামে একটি ক্রীড়া-প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়। শেখ জামালের নামে গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া উপজেলায় প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে “শহীদ শেখ জামাল যুব প্রশিক্ষণ কেন্দ্র।”

                                                                                                      তথ্যসূত্র :    মুজিবপিডিয়া


শেখ রেহানা

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুননেছা মুজিবের ছোট মেয়ে শেখ রেহানা। তিনি মুজিব-রেণু দম্পতির চতুর্থ সন্তান। তাঁর জন্ম ১৯৫৭ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর, ঢাকার মিটফোর্ড হাসপাতালে। মায়ের ডাকনাম রেণুর প্রথম অক্ষর আর বড় বোন হাসিনার শেষের অক্ষর অক্ষত রেখে সৃষ্টি হয়েছে তাঁর নাম। পারিবারিক পদবি যুক্ত হয়ে পরিপূর্ণ নাম হয় শেখ রেহানা। শেখ রেহানার শৈশব-কৈশোর এবং তারুণ্যের শুরুটা কেটেছে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়িতেই। ১৯৭৫ সালে শেখ হাসিনার স্বামী ও শেখ রেহানার ভগ্নিপতি পরমাণু বিজ্ঞানী এমএ ওয়াজেদ মিয়া সে-সময়ের পশ্চিম জার্মানিতে উচ্চতর গবেষণা করছিলেন। সে-বছরের ৩০ জুলাই শেখ হাসিনা ও তাঁর সন্তানদের সঙ্গে শেখ রেহানাও জার্মানিতে যান । ১৫ আগস্ট নৃশংস হত্যাকাণ্ডের সময় তাঁরা ছিলেন ব্রাসেলসে। ফলে খুনিচক্রের হাত থেকে বেঁচে যান শেখ রেহানা। ততোদিনে বঙ্গবন্ধুর জীবিত দুই কন্যার শুরু হয়েছে শরণার্থীর জীবন। বেলজিয়ামের ব্রাসেলসে থাকাকালীন তাঁরা ১৫ আগস্টের মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের খবর পান।

১৯৯৮ থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত 'সাপ্তাহিক বিচিত্রা' পত্রিকার প্রকাশক ও সম্পাদক হিসেবে তিনি দায়িত্ব পালন করেন। বর্তমানে তিনি 'জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেমোরিয়াল ট্রাস্ট'-এর সহ-সভাপতি। পাশাপাশি তিনি নানাবিধ সমাজকল্যাণমূলক কর্মকাণ্ডে নিজেকে সম্পৃক্ত রেখেছেন।

জীবনের নানা চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ রেহানার তিন সন্তান- ছেলে রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববি, মেয়ে টিউলিপ রেজওয়ানা সিদ্দিক ও আজমিনা সিদ্দিক রূপন্তী এখন নিজেরাই নিজ নিজ নামে প্রতিষ্ঠিত। বড় মেয়ে যুক্তরাজ্যের লেবার পার্টির রাজনীতির নাথে যুক্ত রয়েছেন। তিনি হ্যাম্পস্টিড অ্যান্ড কিলবার্ন থেকে নির্বাচিত লেবার পার্টির এমপি। ছেলে রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ইউএনডিপি-তে কর্মরত এবং আওয়ামী লীগের গবেষণা উইং 'সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড ইনফরমেশন' (সিআরআই)- এর ট্রাস্টি। সবার ছোট আজমিনা সিদ্দিক রূপন্তী 'পলিসি অ্যান্ড ইমপ্যাক্ট ম্যানেজার' হিসাবে যুক্তরাজ্যভিত্তিক দাতব্য সংগঠন চিলড্রেন'স সোসাইটিতে কর্মরত। রাজনীতি ও ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকলেও নির্মোহ শেখ রেহানা সব সময়ই অন্তরালেই থেকেছেন। বড় বোন শেখ হাসিনা যখনই কারাবন্দী ও গৃহবন্দী হয়েছেন তখন সংগঠনের সাথে যোগাযোগ করে শেখ হাসিনার মুক্তির আন্দোলনে বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখেছেন তিনি। বিশেষ করে, ২০০৭-২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শাসনামলে শেখ হাসিনার মুক্তি লাভের ক্ষেত্রে তিনি অনবদ্য ভূমিকা রাখেন।

শিল্প-সংস্কৃতির প্রতি তাঁর বিশেষ আগ্রহ রয়েছে। শেখ রেহানা নিয়মিত লেখালেখি করেন। ২০১১ সালে প্রকাশিত তাঁর প্রবন্ধ গ্রন্থের নাম 'জনসমুদ্রে এক মহামানব'। তাঁর সম্পাদিত গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে 'বাঙালির কলঙ্কমোচন' (২০০২), 'সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি' (২০০৫), 'জাতীয় নির্বাচন' (২০০৮)। বাবা ও মাকে নিয়ে হৃদয়গ্রাহী কবিতা লিখেছেন শেখ রেহানা। কবিতা দুটি প্রকাশিত হয়েছে 'জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশত বার্ষিকী উদযাপন জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটি থেকে প্রকাশিত 'কোটি মানুষের কণ্ঠস্বর' ও 'মুজিব চিরন্তন' স্মরণিকায়। গোপালগঞ্জ জেলায় তাঁর নামে ‘শেখ রেহেনা টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, গোপালগঞ্জ’ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।


                                                                                                                                                                                                                                                                                                          তথ্যসূত্র :    মুজিবপিডিয়া

শেখ রাসেল

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও বঙ্গমাতা ফজিলাতুননেছা মুজিব দম্পতির সর্বকনিষ্ঠ সন্তান শেখ রাসেল। তাঁর জন্ম ১৯৬৪ সালের ১৮ অক্টোবর, ঢাকায় ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়িতে। শেখ রাসেলের নামকরণ নিয়ে স্মৃতিচারণায় শেখ হাসিনা লেখেন, “অনেক বছর পর একটা ছোট্ট বাচ্চা আমাদের বাসায় ঘর আলো করে এসেছে, আনন্দের জোয়ার বয়ে যাচ্ছে। আব্বা বার্ট্রান্ড রাসেলের খুব ভক্ত ছিলেন, রাসেলের বই পড়ে মাকে বাংলায় ব্যাখ্যা করে শোনাতেন। মা রাসেলের ফিলোসফি শুনে শুনে এত ভক্ত হয়ে যান যে, নিজের ছোট সন্তানের নাম রাসেল। রাখেন।”

উত্তাল রাজনৈতিক পরিবেশ আর নানা সংকটে পূর্ণ শৈশব কাটাতে হয় শেখ রাসেলকে। পিতা শেখ মুজিব স্বৈরশাসক আইয়ুব বিরোধী রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে তখন সক্রিয়, পুনরুজ্জীবিত করছেন আওয়ামী লীগকে। পিতার সান্নিধ্য পাওয়ার সুযোগ খুব কমই ঘটেছে রাসেলের জীবনে। ১৯৬৬ সালে রাসেলের বয়স যখন মাত্র দেড় বছর সে-সময় ছয় দফা দাবিসহ অন্যান্য রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের কারণে গ্রেপ্তার হয়ে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি হন শেখ মুজিব। রাসেলের সবচেয়ে প্রিয় সঙ্গী ছিলেন তাঁর বড় বোন শেখ হাসিনা, যাঁকে তিনি ‘হাসুপা’ নামে ডাকতেন।

বিজয় লাভের পর শেখ রাসেলকে রাজধানীর ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি স্কুলে দ্বিতীয় শ্রেণিতে ভর্তি করানো হয়। শৈশবে তাঁর দুরন্তপনার সঙ্গী ছিলো একটি বাইসাইকেল। ধানমন্ডির আবাসিক এলাকার ৩২ নম্বর সড়কে তিনি বন্ধুদের সাথে সাইকেল চালাতেন। পাকিস্তান কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে বঙ্গবন্ধু যখন দেশে ফিরে আসেন, রাসেল তখন সবসময় তাঁর বাবার কাছে থাকতে চাইতেন। বঙ্গবন্ধুরও ইচ্ছে ছিল বাইরের পৃথিবী সম্পর্কে জানুক রাসেল। তাই তিনি জাপান, ভারত, যুগোশ্লাভিয়া সফরে রাসেলকে সঙ্গে নেন। বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানেও পিতার সাথে রাসেল অংশ নেন।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট মাত্র ১০ বছর বয়সে বঙ্গবন্ধুসহ পরিবারের অন্যান্য সদস্যের সঙ্গে ঘাতকদের হাতে নির্মম হত্যাকান্ডের শিকার হন শেখ রাসেল। বনানীতে পাশাপাশি শেখ পরিবারের সাতজন সদস্যের কবর রয়েছে। সপ্তম কবরটি শেখ রাসেলের।

শেখ রাসেলের স্মৃতিকে ধরে রাখার জন্য ১৯৯৫ সালে ফুটবল ক্লাব শেখ রাসেল ক্রীড়া চক্র প্রতিষ্ঠা করা হয়। ১৯৮৯ সালে প্রতিষ্ঠা করা হয় ‘শেখ রাসেল জাতীয় শিশু-কিশোর পরিষদ’। তাঁর নামে ঢাকার পান্থপথ ও ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কের সংযোগস্থলকে ‘শেখ রাসেল স্কয়ার’ নামকরণ করা হয়েছে। ২০২১ সালের ১৮ অক্টোবর থেকে প্রতি বছর রাসেলের জন্মদিনটি জাতীয়ভাবে ‘শেখ রাসেল দিবস’ হিসেবে পালিত হয়। ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নে দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ‘শেখ রাসেল ডিজিটাল ল্যাব’ গড়ে তোলা হয়েছে। গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় ‘শেখ রাসেল দু্:স্থ শিশু প্রশিক্ষণ ও পুনর্বাসন কেন্দ্র’ গড়ে তোলা হয়েছে।


   তথ্যসূত্র :    মুজিবপিডিয়া